অপ্রত্যাশিত চিঠি
-রুদ্র প্রসাদ
তৃতীয় পর্বের পর………
( ১০ )
বিকেলে তাজপুরে নেমে একটা খালি টোটোতে উঠে বসে জানতে পারলাম, আরও দু-তিনজন যাত্রী না পাওয়া পর্যন্ত যাবে না । অগত্যা বসে বসে গান শুনছিলাম, এমন সময় দেখি সেই সৈকত সুন্দরী, এসে আমার সামনের খালি জায়গায় বসল ! কিছুক্ষণ আমাকে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করে স্বগোতক্তি করল, “আমি পরে এসেছি, তার মানে আমার পিছু ধাওয়া করছেন না, … হুঁ ।” কোনো মন্তব্য না করে অন্যদিকে মুখ ফেরালাম । একটু পরে দেখি খুব স্মার্টভাবে ডানহাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, “হাই, আমি রাই ।” হাতটা দেখে একটু আশ্চর্য লাগলেও করমর্দন না করেই মুখে “হ্যালো” ছাড়া আর কিছু বললাম না । আমার আচরণ বোধহয় তার ঠিক পছন্দ হ’ল না, এবার দেখি নিজেই আমার ডানহাতটা ধরে একটু ঝাঁকিয়ে নিল । ইতিমধ্যে আরও একজন যাত্রী পেয়ে টোটো চলতে শুরু করেছে । মৃদু আলাপচারিতার পর আমি রাস্তার পাশে মৎস্য দপ্তরের বিশাল জলাশয় ছাড়াও ছোট-বড় অনেক পুকুর দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম, মেয়েটা অনর্গল বকেই চলেছে । মনে মনে ভাবলাম, ‘এতো এনার্জি পায় কোত্থেকে কে জানে’ ! আমার গন্তব্যে পৌঁছে বিদায় জানাতে রাই বলল, “আবার দেখা হবে নিশ্চয়ই” । সম্মতিসূচকভাবে মাথা নেড়ে হাঁটতে শুরু করলাম ।
বাড়ি ফিরে দাদুকে কোথাও দেখতে পেলাম না । রতন আর আবীর লালকে দেখতে পেলেও বিশেষ কিছু না বলে ওপরের ঘরে এলাম । হাত-মুখ ধুয়ে ক্যামেরাটা নিয়ে ছাদে যেতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, ছাদে যাওয়ার সিঁড়ির মুখে দরজাটা এমনি আটকানো, কোনো তালা-চাবির বালাই নেই । দরজা ঠেলে ছাদে গিয়ে দেখি, সেখানেও গাছপালার কমতি নেই । সারি সারি টবে প্রচুর গাছ লাগানো, পাতাবাহার আর ক্যাক্টাসই বেশি । ছাদে দাঁড়িয়ে গাছপালার ফাঁকে সূর্যাস্ত ক্যামেরাবন্দী করার সময়, ছাদ থেকে বাড়ির চারপাশটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিলাম । নিম গাছটা নিচ থেকে দেখেছিলাম, এবার ছাদ থেকেও ভালো করে দেখে নিলাম । যতগুলো সম্ভব ছবি তুলে সূর্য ডোবার পর নিচে নেমে আসতে গিয়ে দেখি সিঁড়ির মুখেই রতন দাঁড়িয়ে । জিজ্ঞেস করে জানলাম, দাদু তখনও ফেরেন নি ।
ঘরে এসে ল্যাপটপে বাড়ির চারপাশের ছবিগুলো দেখছিলাম, এমন সময় মায়ের ফোন । কথাবার্তা সেরে নিচে এসে জলখাবার খেয়ে আবার ঘরে গিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসলাম । বিভিন্ন দিক থেকে, বাড়ির চারপাশের যত ছবি তুলেছি, আর ল্যাবের ভেতরের ভিডিওটেপটা বারবার করে দেখলাম । মনে মনে আর একবার পুরো পরিকল্পনাটা ভেবে নিয়ে ভাইকে মেসেজ করলাম, একটু পরে রিপ্লাই এলো, ‘সাবধানে’ ।
ভেতরে ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা নিয়ে খেতে গেলাম । তখনও দাদুকে দেখতে না পেয়ে বেশ আশ্চর্য হ’লাম । জিজ্ঞেস করে জানা গেল, ‘দাদু একটু আগেই ফিরেছেন । কোথাও গিয়েছিলেন, যেখানে অবেলায় খাওয়া হয়েছে । তাই রাতে আর কিছু খাবেন না । আজ একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছেন’ ।
আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শুরু করলাম । প্রতিটা খাওয়ারকেই সন্দেহ করার জন্য ঠিকমত খেতেও পারলাম না । যাই হ’ক, নামমাত্র খেয়ে উঠে পড়লাম । বিশেষ কিছু না বলে ওপরের ঘরে এসে টানটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম । বেশ কিছু সময় পর হঠাৎ মনে হ’ল ঘরের বাইরে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে । আমি চুপচাপ শুয়ে শুয়ে সময় কাটিয়ে যাচ্ছি । একসময় মনে হ’ল এখন আর কেউ নেই । রাত বাড়তে লাগল ।
( ১১ )
বাইরে তখন হালকা বৃষ্টি পড়ছে । হাতঘড়িতে বারোটা বাজতেই উঠে পড়লাম । সদ্য কেনা গামছাগুলো দুটো করে জুতোর ওপর বেঁধে নিলাম, যাতে চলাফেরার সময় জুতোর ছাপ না পড়ে । নাইলনের দড়ির গোছাটা কাঁধে পেঁচিয়ে, এমার্জেন্সী কিটটা নিয়ে, উইন্ডচিটারটা গলিয়ে বেরিয়ে এলাম । চারপাশটা দেখতে গিয়ে বেশ অবাক হয়ে গেলাম । ওপরের তলায় আমি ছাড়া কেউ থাকে না – এটা আগের দিনই দেখেছিলাম । এখন দেখছি নিচের ঘরেও কেউ নেই ! ঘরগুলোর দরজা সব বাইরে থেকে বন্ধ !!!
আর সময় নষ্ট না করে ছাদে এলাম । ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেই নিম গাছ বেয়ে নিচে নামলাম । চলার পথের দুপাশেই বড় বড় ঘাস থাকায় মোটামুটি নিঃশব্দেই চললাম ল্যাবের দিকে । কিন্তু কিছুটা যাওয়ার পর দাঁড়াতে হ’ল । বাইরে গেটের কাছে একটা গাড়ি থামার আওয়াজ পেলাম । একটু পরেই শুনতে পেলাম কয়েকটা পায়ের শব্দ এদিকেই এগিয়ে আসছে । আর ঠিক তখনই খেয়াল করলাম, ল্যাবের দিক থেকেও এই দিকে কয়েকজন সশব্দে এগিয়ে আসছে । আমি ঠিক মাঝখানে ।
( ১২ )
টর্চের আলোর সাথে সাথে পায়ের শব্দগুলো ক্রমশই এগিয়ে আসছে । স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে ছিলাম, হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে তাড়াতাড়ি করে পাশের ভুঁই-চাঁপার ঝোপের আড়ালে গিয়ে এবড়ো-খেবড়ো জমিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম । অন্ধকারে কিছুটা চোখ সয়ে গিয়েছিল, ওদের টর্চের আলো আরও কিছুটা সুবিধা করে দিল, দেখলাম পেছনের দিক থেকে তিনটে লোক আসছে । তাদের মধ্যে দুজন একটা বস্তার মতো কিছু, ধরাধরি করে নিয়ে আসছে । সামনের দিক থেকে আরও দুজন লোক আসছে । দুপক্ষ এসে দাঁড়াল একেবারে আমার সামনে । বড় জোর কয়েক হাতের ব্যবধান । হাতের টর্চটা ঘুরিয়ে আলো ফেললেই চিত্তির – ভাবতেই শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল । কপাল ভালো বলতে হবে, সামনা-সামনি হতে উভয়পক্ষই টর্চের আলো নিভিয়ে ফেলল ।
ল্যাবের দিক থেকে আসা দুজনের একজন নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করল, “সাহেব, আজ এতো দেরি ? রাস্তায় সমস্যা হয় নি তো ?” গলার আওয়াজে চিনলাম, এ সেই খিটকেল আবীর লাল মিশ্র ।
ওদিক থেকে আসা সামনের লোকটাও চাপা গলায় উত্তর দিল, “সব ঠিক আছে” । আর কিছু না বলে, ওরা পাঁচজন ল্যাবের দিকে এগোল । আমিও কিছুটা দূরত্ব রেখে ওদের অনুসরণ করতে লাগলাম । ওরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিল, কিন্তু দূরে থাকার জন্য কথাগুলো ঠিকমতো শুনতে পারছিলাম না ।
ওরা ল্যাবের ভেতর ঢোকার পর, বাইরে থেকে দেখার চেষ্টা করে কোনও লাভ হল না । ভেতরে কোনো আলো না থাকায়, কিছুই বুঝতে পারলাম না । ল্যাবের চারপাশটা ঘুরেও কিছু উদ্ধার করতে পারলাম না, ওরা যেন জমাট অন্ধকারে কোথাও হারিয়ে গেল । হাল ছেড়ে দিয়ে, একটা আমগাছের আড়ালে থেকে, ল্যাবের দরজার দিকে নজর রেখে, অপেক্ষা করতে লাগলাম । সময় গড়িয়ে চলল ।
( ১৩ )
বেশ কিছু সময় পর, ল্যাব থেকে চারজন বেরিয়ে এলো । বাইরের দিকে চলতে শুরু করল দেখে বুঝলাম, এরা ফিরে যাচ্ছে । আগের বারের মতো নয়, এবার দূরত্ব কমিয়ে, প্রায় ওদের পেছন পেছন চলতে লাগলাম । ঘরের সামনে এসে দলটা হঠাৎ থমকে দাঁড়াল, একটু আগে শোনা সেই সাহেব গলাটা নামিয়ে বলে উঠল, “সেই ছেলেটার কি খবর ? লালু, আজ আবার ওষুধ দিস নি তো ?”
“না, আজ আর দেই নি”, আবীরও তেমনি উত্তর দিল, “খেয়ে-দেয়ে ঘুমোচ্ছে, রতন দেখে এসেছে । ওকে নিয়ে চিন্তা করবেন না সাহেব”।
“আমি তো বললাম, চিন্তার কিছু নেই । তা ও তোরা শুনলি না, পেছন পেছন গেলি । আরে বাবা, এখানে বেড়াতে এসে একটা ছেলের কিছু হয়ে গেলে, পুলিশ এসে হাঙ্গামা বাধাবে না ? অত ঝামেলার কি দরকার ? তাছাড়া, কাল বাদে পরশু যখন চলেই যাবে, ফালতু ঘাঁটিয়ে লাভ কি ? খালি নজরে রাখিস । আমি না বললে, আগ বাড়িয়ে, নিজে থেকে কিছু করতে যাস না । বুজেছিস ?” বলে সেই সাহেব একটু থামল । তারপর আবার বলল, “চুপচাপ নিজের কাজ করে যা । আর বুড়োর খেয়াল রাখিস”। বলেই চলতে শুরু করল ।
এই সাহেবের গলাটা আমার খুব চেনা লাগলেও ঠিক কার গলা আর কোথায় শুনেছি, কিছুতেই মনে করতে পারলাম । ভাবতে ভাবতেই ওদের অনুসরণ করতে লাগলাম । ওরা যখন গেটের কাছে পৌঁছাল, আমিও ততক্ষণে গাছের আড়ালে, ঝোপঝাড় ঠেঙিয়ে, কাঁটাতারের বেড়ার কাছে পৌঁছে গেছি । দেখলাম, একটা নয়, দুটো গাড়ি । মাঝারি উচ্চতার সেই সাহেব আর আবীর ছাড়া বাকি দুজন সামনের গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল । সামনেরটা ঠিক বুঝতে না পারলেও ওদের টর্চের আলোতে পেছনের কালচে গাড়িটা যে হাল আমলের ফোর্ড এণ্ডেভার, সেটা চিনতে অসুবিধা হল না । তবে নম্বরটা দেখা গেল না । সাহেবকে পেছনের গাড়িতে উঠতে দেখে বুঝলাম, গাড়িতে অন্তত একজন ড্রাইভার, আগে থেকেই আছে । গাড়ির ব্যাকসিটে বসে সাহেব বলল, “আজকের মালটা সাবধানে রাখিস । কোনোরকম ঝামেলার আভাস পেলেই আমাকে খবর দিবি”। গাড়ির ইঞ্জিন চালু হতেই আবীর ফিরতে উদ্যত হল । পেছনের গাড়িটা হেডলাইট জ্বালাতেই চমকে উঠলাম । সামনের নম্বরপ্লেট বিহীন পিক-আপ ভ্যানটার পেছনে, বামদিকে তিনকোনা রিফ্লেক্টরটা আলো পড়ে জ্বলজ্বল করছে !
( ১৪ )
গাড়ি দুটো এগিয়ে গেল তাজপুর-বালিসাই সি-বিচ রোডের দিকে । আবীরকে ফিরে আসতে দেখে, কিছুটা পেছন পেছন আসার পর, যখন দেখলাম সে আবার ল্যাবের দিকে যাচ্ছে, তখন হঠাৎ করে একটা কথা মনে হতেই অনুসরণ না করে উল্টোপথ ধরলাম । এবার গেট দিয়েই বাইরে এলাম । এসে বুঝতে পারলাম, আমার অনুমান সঠিক । সামনের ঐ অপরিসর রাস্তাতে এস-ইউ-ভি কেন, ছোট গাড়িও ঘোরানো অসম্ভব । তার মানে, গাড়ি দুটো উল্টো দিক থেকেই এসেছে । রাস্তাটা কোথায় গেছে, ওদিকে কি আছে কৌতূহল কিছুতেই দমন করতে পারলাম না । রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চললাম সামনের দিকে । উত্তেজনার বশে খেয়ালই হল না কখন বৃষ্টির বেগটা বেশ বেড়েছে । কিছু দূর যেতেই সমুদ্রের গর্জন আর ঢেউ ভাঙার জোরালো আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পেলাম । আরও এগিয়ে দেখি, সমুদ্রের ধারেই পৌঁছে গেছি ! বিদ্যুতের ঝলকানিতে চোখে পড়ল, কয়েকটা নৌকা সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । তল্লাটে জন-মানবের কোনও চিহ্নই নেই । বৃষ্টিতে ভিজে শীত শীত করায়, আর দাঁড়িয়ে না থেকে, ফিরে চললাম ।
ফিরে এসে ল্যাবের দিকে যাব বলে এগিয়ে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালাম । এভাবে সামনে দিয়ে যাওয়াটা বড় বেশি ঝুঁকিবহুল হয়ে যাবে, ভেবেই পুকুরের পাড় দিয়ে ঘুরে ল্যাবের পেছনের দিকে গিয়ে পৌঁছালাম । আন্দাজে বকুল গাছটার কাছাকাছি পৌঁছে গেলেও অন্ধকারে ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না । আলো জ্বালার সাহস হল না । আপশোস হতে লাগল, কেন যে সব কিছু খুঁটিয়ে দেখে রাখি নি । মনে মনে নিজের ওপর বিরক্ত হলেও, করার কিছু ছিল না । এমনি এমনি দাঁড়িয়ে থেকে, আর সময় নষ্ট না করে ফিরে চললাম ।
এসে নিমগাছে চড়তে গিয়ে টের পেলাম, নেমে আসা যতটা সহজ কাজ ছিল, ওপরে ওঠা তার চাইতে ঢের বেশি কঠিন, বিশেষতঃ এই ভেজা গাছে । রীতিমতো পরিশ্রম করে, বেশ কিছু সময় ব্যয় করে, শেষ পর্যন্ত ছাদে উঠতে পারলাম । ছাদে উঠে বুঝতে পারলাম, বৃষ্টিটা বেশ ধরে এসেছে । দরজার কাছে এসে উইন্ডচিটার, জুতো, জামাকাপড় – সব খুলে, হাতে করে নিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে পা টিপে টিপে নেমে এলাম । ঘরে এসে, শুকনো জামাকাপড় পরার পর মোটামুটি বিস্তারিতভাবে সবকিছু ভাইকে মেসেজ করে যখন শুতে যাচ্ছি, তখন পূর্বদিক প্রায় ফরসা হয়ে এসেছে । শুরু হচ্ছে আরও একটা নতুন দিন ।
to be continued…
Chapter 5 (Coming soon, 24th April, 18)